বাংলাদেশ-ভারত-চীন ত্রিভুজের জটিল কূটনীতি

 বাংলাদেশ-ভারত-চীন ত্রিভুজের জটিল কূটনীতি

জয়ন্ত ঘোষাল

১৪ জুন, ২০২২

বাংলাদেশ-ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক


খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে চীন যখন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল, তখন তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। এমন একটা ছোট রাজ্যের সেনাপ্রধান ছিলেন সুন ঝু। এই মানুষটি রণকৌশলে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, যুদ্ধে পারঙ্গম। তাঁর ‘আর্ট অব ওয়ার’ আজ পৃথিবীবিখ্যাত বই। যুদ্ধনীতিবিষয়ক এই বই তৎকালীন সমাজ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও আজ পুরো পৃথিবীর সামরিক দর্শনে তার প্রভাব রয়েছে। চীনের সামরিক দর্শন বুঝতেও এই বইটির জুড়ি মেলা ভার।


সুন ঝু বলেছিলেন, কৌশলের চরম উত্কর্ষ বোঝা যায় তখনই যখন লড়াই না করে শত্রুকে পরাভূত করা সম্ভবপর হয়। বিনা রক্তপাতে যুদ্ধজয়। শত্রুসেনা বা প্রতিরোধ ধ্বংস করার চেয়েও জরুরি হলো শত্রুর মনোবল নষ্ট করে দেওয়া। এর জন্য একদিকে নিজেকে যেমন ক্রমেই এক অপ্রতিরোধ্য, দুর্দমনীয় মনোভাব নিয়ে যেতে হবে; অন্যদিকে শত্রুর রণকৌশল, তার মিত্র দেশ, তার শক্তির উপাদান—এসব হবে আক্রমণের লক্ষ্য। সুতরাং সোজা কথায় শত্রুকে শক্তি সঞ্চয় থেকে বিরত রাখা আর নিজের নিরন্তর শক্তি বৃদ্ধি এবং সামরিক নীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের ধোঁকা দিতে হবে, ঠকাতে হবে, চমক দিতে হবে—এ রকম নানা রকমের প্রবঞ্চনাও দরকার। যখন আমরা আক্রমণ করতে সক্ষম, তখন অক্ষমতা দেখাতে হবে। যখন সেনাবাহিনী সচল, তখন দেখাতে হবে আমরা নিষ্ক্রিয়। যখন আমরা কাছে এসে পড়েছি, তখন শত্রুকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা অনেক দূরে আছি। এ ধরনের নীতি শত্রুর মনে একটা অনিশ্চয়তার জন্ম দেবে। অনেক সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তখন অতর্কিতে চীনা যুদ্ধ শুরু হবে। সুন ঝু এটাও বলেছিলেন যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ কখনো কার্যকর হয় না। যুদ্ধ অতর্কিতে শুরু হবে, অতর্কিতে শেষ হবে। সুতরাং কোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে চলার পক্ষপাতী ছিলেন না সুন ঝু।

চীনের রণকৌশল আজও প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটা দীর্ঘ সময় ধরে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করেছে, তখনো সেই সমাজ কিন্তু হয়নি। রাজরাজড়া ছিল, চীন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সেই চীনের ওপর যে অত্যাচার, তার জন্যই বোধ হয় এত বেশি করে আত্মসচেতন হয়ে নিজেদের রক্ষা করতেও শিখেছে। কিন্তু চীন সমাজতন্ত্রী হওয়ার পর নিজেরা যুদ্ধ করেছে কম। ১৯৬২ সালে ভারত আক্রমণ অবশ্য এই উপমহাদেশের কূটনৈতিক ছবিটাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। ভারতের সঙ্গে চীনের যে ‘হিন্দি-চীনি ভাই-ভাই’ সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছিল, পঞ্চশীল নীতি ইত্যাদি শব্দ সেই অবিশ্বাস ভারত ও চীনের সম্পর্কে এখনো বাষ্প হয়ে রয়েছে। আর এই চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতি এই উপমহাদেশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে।


রাশিয়ার ইউক্রেনকে আক্রমণ আর চীনের ভারত আক্রমণ তো এক নয়। ভারত একটি বিশাল দেশ, ইউক্রেনের ভৌগোলিক আয়তনের তুলনায় অনেক বড়। সেই ভারতের যদি নিরাপত্তার অভাব বোধ হয়, তাহলে তার প্রভাব শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর কূটনীতিতে পড়ে। আবার আমেরিকার সঙ্গে চীনের সখ্য প্রভাব বিস্তার করছে আজকের দুনিয়ায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকা, চীন আর পাকিস্তান এই তিনটি দেশের একটি সখ্য গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোণঠাসা করার জন্য। আমরা জানি, রিচার্ড নিক্সন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি কিভাবে হেনরি কিসিঞ্জারকে পাঠিয়ে আমেরিকা ও চীনের বরফ গলিয়েছিলেন। আর সেই বরফ গলাতে সবচেয়ে প্রথম দিকে যিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনি একজন মার্কিন সাংবাদিক, এডগার স্নো। চীনের দ্বৈরথে ভারত কোথায় দাঁড়াবে সেটা একটা মস্তবড় প্রশ্ন। আর ভারত কোথায় দাঁড়াবে তাতে আবার এই উপমহাদেশের অন্যতম জটিল প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য। এর কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা ঐতিহাসিক, দীর্ঘদিনের। যাকে বলে একটা ‘টেস্ট অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ’, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠন হওয়ার সময় থেকে। আর সে কারণে বাংলাদেশের ওপরও কূটনৈতিক চাপ অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে কী বলা হয়েছে সেটা বোধ হয় এখন স্মরণ করা অবশ্য কর্তব্য। তাহলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ, ভারত আর চীন—এই ত্রিভুজের কূটনীতি আজ কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আর কেন এত জটিল হয়ে গেছে।


১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যখন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হলো, সেই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কী ছিল, আমরা তা ভুলে যাইনি। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের কী সম্পর্ক ছিল, সেটাও ভেবে দেখলে প্রেক্ষাপট বুঝতে সুবিধা হবে। কিন্তু সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার স্বাধীন স্বনির্ভর পররাষ্ট্রনীতির পথে ক্রমেই এগিয়েছে। ভারতের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব এবং নির্ভরশীলতা থাকলেও চীনের সঙ্গে অবৈধ পথে বাংলাদেশ কখনো যায়নি, যেতে চায় না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বলে যে একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা মানে অন্যজনের সঙ্গে শত্রুতা করা নয়। এমন কোনো সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নিতে চায় না বা এমন কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হতে চায় না, যেখানে অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরোধিতার জন্য সেটা তৈরি হবে। সে কারণে সম্প্রতি ওয়াশিংটনের প্রস্তাবেও বাংলাদেশ রাজি হয়নি। যেখানে একটা এমন গোষ্ঠী তৈরি করতে চাইছে আমেরিকা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বেশ কিছু রাষ্ট্রকে মিত্রশক্তি হিসেবে তৈরি করার সেই পথে বাংলাদেশ হাঁটেনি। কিন্তু বাংলাদেশ আয়তনের তুলনায় ছোট, কিন্তু তার জিও-স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অসীম, সে কথা তো আমি বারবার বলি। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে এই চাপটা সহ্য করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। বিশেষ করে আরো জটিল হয়, যখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে মতপার্থক্য হয় বা সম্পর্কের অবনমন হয়।

যেমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি যে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক দেওয়া নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। বাংলাদেশ অর্থ চুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় কিস্তির প্রতিষেধক ভারত পাঠাতে পারেনি। চীনের কাছ থেকে প্রতিষেধক বাংলাদেশকে নিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের ইচ্ছা না থাকলেও আবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরাসরি অর্থ না নিলেও চীনা প্রযুক্তি নেওয়ার কোনো বাধা থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করতে চলেছেন। সেই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদে তৈরি হয়েছে, যেটা একটা জাতীয় গৌরব হতে চলেছে। কিন্তু চীনা প্রযুক্তি পদ্মা সেতু নির্মাণে সাহায্য করেছে। চীনা ইঞ্জিনিয়াররা এসেছেন এবং বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা খুব পুরনো প্রতিরক্ষা চুক্তিও আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে চীন যেটা চাইছে যে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনত্বটা কমিয়ে দিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চীনের ওপর নির্ভরশীলতাটা বাড়ুক। কিন্তু চীনের ওপর আর্থিক নির্ভরতা বাড়াতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার যে কী অবস্থা হলো, সেটা বাংলাদেশ দেখেছে এবং পুরো পৃথিবী দেখেছে।


আবার বাংলাদেশের অন্য একটা সমস্যা হচ্ছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও উগ্র হিন্দুত্ববাদ। বিজেপির মুখপাত্রের আপত্তিকর মন্তব্যে সারা বিশ্বে ভারতের সমালোচনা হয়েছে।


এই পরিস্থিতিটা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এই ত্রিভুজের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বেশ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উপসাগরীয় দেশগুলো পর্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতে আসা বিদেশি মুদ্রার অর্ধেকই (৪০ বিলিয়ন ডলার) পাঠানো হয় উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে। এসব দেশে কাজ করে ৮.৯ মিলিয়ন ভারতীয়। আরব রাজনীতি মিলেমিশে যখন ভারতকে কোণঠাসা করছে, আর তখনই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটা আরো জটিল হয়ে উঠছে। তাই এই মুহূর্তে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, উত্তেজনা প্রশমিত করা। দেশের ভেতরে নরেন্দ্র মোদির উচিত অবিলম্বে কঠোর হস্তে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ন্ত্রণ করা। নূপুর শর্মা যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সমর্থনে কোনো মন্তব্য কখনো কোনো বিজেপি নেতা যেন করে না বসেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ করেছেন, তাতে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এই অবস্থায় কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে পররাষ্ট্রনীতি অটুট রাখতে হবে। এখন বাংলাদেশকে একটু ধীরে চলো নীতিতে এগোতে হবে। নরেন্দ্র মোদি এই বক্তব্যকে বলেছেন ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট। সেটা যে মুখের কথা নয়, বাস্তবে তার প্রমাণ দিতে হবে। তা না হলে এই ত্রিভুজের সম্পর্কটা নিয়েও কিন্তু আবার আগামী দিনে জটিলতা বাড়বে।

 লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি


কালেরকণ্ঠ

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url