চীন- তাইওয়ান সংকট ও বর্তমান বিশ্বরাজনীতি
চীন- তাইওয়ান সংকট ও বর্তমান বিশ্বরাজনীতি নিয়ে লিখলাম, পড়তে পারেন। নিশ্চিত নতুন কিছু জানতে পারবেন, আশাকরি।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন - "মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নিম্ন কক্ষের স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির সাম্প্রতিক তাইওয়ান সফর এ অন্ঞ্চলের শান্তি ও স্হিতিশীলতার জন্য হুমকি"।
অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন - "তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্যই হলো চীনকে উস্কানি দেওয়া"।
ন্যান্সি পেলোসির সাম্প্রতিক তাইওয়ান সফর নিয়ে বিশ্বরাজনীতির মাঠ আবারও উত্তপ্ত। ইউক্রেন -রাশিয়া যুদ্ধে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পরাশক্তিগুলো জড়িয়ে পড়েছে, অপরদিকে চীন তাদের মতো এগিয়ে চলেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের একক আধিপত্যের জন্য ভবিষ্যৎ হুমকি মনে করে চীন কে। যার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মোটাদাগে বললে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান, শি জিনপিং এর BRI প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রভাববলয় বৃদ্ধি, সামরিক শক্তিমত্তা, সাম্প্রতিক সময়ের উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোম্যাসি ইত্যাদি।
যাহোক, বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে পেছনে ফিরে থাকাতে হবে আমাদের ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পরে তখনই বিশ্বমঞ্চে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ১৮২৩ সালের মনরো ডকট্রিন অর্থাৎ অ্যামেরিকা ইউরোপ নিয়ে নাক গলাবে না, ইউরোপও অ্যামেরিকার ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করবে না এমন নীতি ভেঙে বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্ব হাতে নিয়ে নেয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব যখন দুটি ব্লকে বিভক্ত (মার্কিন নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক, ও সাবেক সোভিয়েত নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক) হয়ে পরে তখন যুক্তরাষ্ট্র ট্রু ম্যান ডকট্রিন ও মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে বিশ্বে প্রভাব বৃদ্ধি করে।
বলে রাখা ভালো তখন জাতিসংঘের সদস্য ছিল তাইওয়ান। উল্লেখ্য যে, চীন ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আমেরিকাপন্থী চিয়াং কাইশেক সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তথা বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর রাজনৈতিক দল। আর চিয়াং কাইশেকের সরকার পালায়ে গিয়ে ফরমোজা দ্বীপে অর্থাৎ বর্তমান তাইওয়ান দ্বীপে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তারা রিপাবলিক অফ চায়না নামে সরকার পরিচালনা করে এবং স্বপ্ন দেখে একদিন মূল চায়নায় আবার ক্ষমতায় বসবে। কিন্ত শি জিনপিং এর পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না সরকার তাদেরকে দেশদ্রোহী হিসেবেই আখ্যায়িত করে। বেইজিং মনে করে তারা তাদের ভূ-খণ্ড যেকোনো মূল্যে দখলে নিবে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে হলেও।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় থাকলেও জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয় নি। তাই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানকেই মূল চীন হিসেবে জাতিসংঘের স্হায়ী সদস্য ভাবা হতো। আমেরিকা তাইওয়ানকে সহযোগিতা করেছে বিপ্লবের পর থেকেই কারণ আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়, বাণিজ্য বজায় রাখতে চায়, তাছাড়া চীনের ভবিষ্যৎ উত্থানকে মোকাবেলা করতে চায়। কিন্তু, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কিউবা সংকটসহ উত্তেজনা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সোভিয়েত শক্তিকে মোকাবেলা করতে চীনকে ব্যবহারের চিন্তা করে তৎকালীন নিক্সন প্রশাসন। তাই হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পিংপং ডিপ্লোম্যাসির মাধ্যমে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করার চেষ্টা চালায়। চীনও তখন বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য একটাই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলা চীনের সহযোগিতায়। তাই তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে চীনকে জাতিসংঘের সদস্য করা হয়। ১৯৭৯ সালে কূটনৈতিক দপ্তর স্হাপন করা হয় বেইজিং এ। এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে একক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় বিশ্বে।
নব্বইয়ের দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে চীন বাণিজ্যে মনোযোগ দেয়। ফলে একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকেই চীনের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে তাদের উত্থান শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে চীন জাপানকে পেছনে ফেলে বিশ্বে ২য় শীর্ষ অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়। এবং ধারণা করা হয় তারা ২০২৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ স্হান দখল করবে চীন।
এছাড়াও ২০১৩ সালে শি জিনপিং এর বি আর ই পরিকল্পনা, চীনের Deft Trap Diplomacy, flagship diplomacy, wolf warrior diplomacy, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অর্থনীতি, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রভাব বৃদ্ধি, আফ্রিকার জিবুতিতে সামরিক ঘাটি স্হাপন, পাকিস্তানের গোয়াদার, ইরানের চাবাহার দখল, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুন্জে সামরিক ঘাটি নির্মাণ, আফ্রিকা ও ল্যাটিনের দেশগুলোতে প্রভাব বৃদ্ধি, NDB ও AIIB ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, হুওয়াই সহ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ চীনকে ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলে বিশ্বমঞ্চে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তাদের ভবিষ্যৎ হুমকি রাশিয়া নয়, চীন ।
তারই প্রেক্ষিতে বিশ্বরাজনীতির ভরকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এশিয়ামুখী হয়ে পড়ে। গত এক দশকে ওয়াশিংটনের কূটনীতিকদের দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় ঘন ঘন সফর, চীন বিরোধী বিভিন্ন ফ্রন্ট যেমন - আইপিএস, কোয়াড, আইপিএফ, অকাস, আই টু ইউ টু ইত্যাদি গঠন এবং সদস্যবৃদ্ধিতে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখে। যার সারকথা একটাই তা হলো চীনকে যুদ্ধে জড়িয়ে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব হ্রাস করা। তাই বিভিন্ন সময়েই উস্কানিমূলক কাজ চালিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাগোষ্ঠী।
* কেন ন্যান্সি পেলোসির এই সফর?
সাম্প্রতিক রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে সুবিধাভোগী রাষ্ট্র হলো চীন।
কারন -
১/ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে কোন দেশই তেল ও গ্যাস কিনতে পারছে না, কিন্তু চীন কম দামে জ্বালানী কিনে তা মজুদ করছে ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না।
২/ যুক্তরাষ্ট্র যেমন ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে যে নীতি নিয়েছিল নন ইন্টারভেনশানিস্ট হয়ে থাকা, কোন দিকেই সরাসরি যুক্ত না হওয়া, বেইজিং কতৃক সেরকম নীতি গ্রহন।
৩/ পরাশক্তিগুলো যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ার মতো অবস্থার সম্মুখীন হওয়া, যেখানে চীন অনেক নিরাপদ ও স্বাভাবিক অবস্থানে থাকা।
৪/ চীনের রাশিয়ারকে পরোক্ষভাবে সহায়তার অভিযোগ করা।
৫/ শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যকার সম্পর্ক।
৬/ যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব চায় তারা যেমন যুদ্ধে ব্যস্ত আছে তেমনি চীনকেও যুদ্ধে নিযুক্ত করে ব্যস্ত রাখতে। রাশিয়া যেমন ইউক্রেন যুদ্ধে পরাজিত না হলেও অনেকটাই দুর্বল হবে, চীনের ক্ষেত্রেও সেরকম যুদ্ধে নিযুক্ত হলে তারাও দুর্বল হবে।
৭/অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রও সুযোগ পাবে নিজেদের পরিকল্পনা শাণিত করতে। তাদের সাম্প্রতিক প্রভাব কমে যাওয়া থেকে কিভাবে আবারো নিজেদের সুপ্রীমিসি লাভ করা যায় তার জন্য একটু সময় নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা সাজানো।
৮/যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
শেষকথা বলতে গেলে এটা বলা যায় - যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি উস্কানির মাধ্যমেই রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ টা লাগিয়ে দিল, আবার চীন - তাইওয়ান যুদ্ধের পরোক্ষ উস্কানি দিয়ে গেলো।
এখন দেখার পালা চীন কি করে?
যুক্তরাষ্ট্রের উস্কানির ফাঁদে পড়ে নাকি অন্য কিছু।
যেকোনো যুদ্ধেই বিশ্ব খারাপ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যায়, রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব আজ ক্লান্ত। তার মধ্যে নতুন করে আবারো যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়বে। অনেক দেশেই অর্থনীতি বিকল হয়ে পড়বে, খাদ্য সংকট চরম পর্যায়ে চলে যাবে।
তাই যে করেই হোক, যুদ্ধ এড়িয়ে কূটনৈতিক সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে।আমাদের বুঝতে হবে - যুদ্ধ যদি সমাধান নিয়ে আসতো তবে আফগানিস্তানের সমাধানও যুদ্ধের মাধ্যমেই হতো, কিন্তু আমরা দেখেছি শেষে কূটনৈতিক সমাধানই সফল হয়েছে।
তাই ন্যান্সি পেলোসির এশিয়া ভ্রমণ নিঃসন্দেহে এক চীন নীতির বিরোধী হলেও চীনের কি রকম প্রতিক্রিয়া আসে তার উপরই নির্ভর করছে পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট। তারই অপেক্ষায় বিশ্ব তাকিয়ে আছে।
*~~~~*~~~~~~*~~~~~*
✍️
S u Rupok
প্রথম লেখা হিসেবে ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। 😄